আওয়ামী লীগের নেত্রী শেখ হাসিনা মিডিয়ার কাছের মানুষ হিসেবে পরিচিত। তাঁর ঘনিষ্ঠ সাংবাদিকেরা প্রায়ই তাঁর উষ্ণ হূদয়, আপ্যায়ন এবং কৌতুকপ্রিয় স্বভাবের বর্ণনা দিয়ে থাকেন। তিনি মিডিয়াকে কতটা গুরুত্ব দেন তারও একটি বড় প্রমাণ আমরা গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তাঁর বিচারকালে দেখতে পাই। সে সময় ২০০৮ সালের ১৬ এপ্রিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর খারাপ ব্যবহারের প্রতিবাদে সাংবাদিকেরা আদালত বর্জন করলে তিনি এটি একটি গোপন বিচার হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন। তিনি এই হুমকিও প্রদান করেন যে সাংবাদিকদের উপস্থিত করার উদ্যোগ না নিলে তিনি শুনানি বর্জন করবেন।
১/১১-পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের সে সময়ে সাংবাদিকেরা রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর এবং অন্য রাজনৈতিক নেতাদের হয়রানির বিশদ বিবরণ তুলে ধরা ছাড়াও সে সময় বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো বিভিন্ন টক শোর মাধ্যমে দুই নেত্রীর পক্ষে জনমত পুনরুজ্জীবনের গুরুদায়িত্ব পালন করেন। বিগত সংসদ নির্বাচন চলাকালীন কিছু চ্যানেল দৃশ্যমানভাবে আওয়ামী লীগের পক্ষাবলম্বনও করে।
নিয়তির পরিহাস হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই এখন বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্রকে অঘোষিতভাবে বর্জন করেছেন। গত এক সপ্তাহে তাঁর কয়েকটি সরকারি অনুষ্ঠানে সংবাদ সংগ্রহের জন্য কেবল বিটিভি, বাসসসহ চারটি প্রতিষ্ঠানের সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়, বাকিদের আসতে বারণ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী নিজে বেসরকারি টিভির টক শোতে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যরাতের সিঁধেল চোর উপমা দিয়ে সমালোচনা করেন। প্রধানমন্ত্রীর এই সমালোচনার ভাষা অযৌক্তিক এবং অগ্রহণযোগ্য বলে অনেকের কাছে বিবেচিত হয়েছে। কিন্তু এর চেয়েও অগ্রহণযোগ্য হচ্ছে তাঁর অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বর্জন করা। বিরোধী দলের নেতা থাকাকালীন তিনি কয়েকটি চ্যানেলকে কিছুদিনের জন্য বর্জন করেছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর বর্জন আরও গুরুতর।
বোঝা যায় সার্বিকভাবে প্রধানমন্ত্রী গণমাধ্যমের ওপর রুষ্ট হয়ে আছেন। বিশেষ করে টক শোর প্রতি তাঁর ক্ষোভ অপরিসীম। বিরোধী দলের সংসদ বর্জন এবং বুদ্ধিদীপ্ত সমালোচনায় সামর্থ্যের ঘাটতির কারণে টক শোর আলোচকদের শাণিত সমালোচনা সরকারের কাছে প্রধান মাথাব্যথা হয়ে উঠেছে। সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এসব সমালোচনা খুব অগ্রহণযোগ্য মনে হতে পারে। অতীতের অন্যান্য সরকারপ্রধানদের মতো তিনিও নিশ্চয়ই স্তাবক এমনকি চাটুকার পরিবেষ্টিত থাকেন। এ রকম অবস্থায় থেকে মধ্যরাতের তীক্ষ তীব্র প্রতিবাদী কণ্ঠ তাঁর কাছে গলাকাটা ছুরির মতো মনে হতে পারে! এমন মনে হওয়া অস্বাভাবিক কিছু হয়তো নয়। কিন্তু অস্বাভাবিক হচ্ছে এতে রুষ্ট হয়ে প্রকাশ্যে ও ঢালাওভাবে টক শোর আলোচকদের সিঁধেল চোরের সঙ্গে তুলনা করা।
আমরা প্রধানমন্ত্রীকে সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করতে চাই, গত বিএনপি শাসনামলে ‘ক্রসফায়ার’, বিএনপি-জামায়াত ক্যাডারদের সন্ত্রাস, সরকারের দুর্নীতি ও দলীয়করণের যে চাঁছাছোলা সমালোচনা টক শো, বিভিন্ন সেমিনার এবং পত্রিকার সম্পাদকীয়গুলোতে করা হয়েছে, তা কি তাঁর কাছে অযৌক্তিক মনে হতো? বিএনপির আমলের সমালোচনা যদি অযৌক্তিক না হয়ে থাকে, তাহলে বর্তমান আমলের গুম/হত্যা, ছাত্রলীগের সন্ত্রাস, বিভিন্ন দুর্নীতি এবং চরম দলীয়করণের সমালোচনা অযৌক্তিক কেন হবে? আমি নিজে বিশ্বাস করি বর্তমান সরকার আমলে ব্যর্থতা ও অপরাধের মাত্রা কিছু ক্ষেত্রে আগের সরকারগুলোর তুলনায় বরং বেশি। এটি সত্যি, এই সরকারের আমলে বিএনপি আমলের মতো ২১ আগস্ট ধরনের পৈশাচিক হামলা হয়নি, বিরোধী দলের কোনো সাংসদের জীবননাশ হয়নি, জঙ্গিবাদী তাণ্ডব দেখা যায়নি। কিন্তু এটিও তো সত্যি এ সরকারের আমলে ইলিয়াস আলীসহ বিরোধী দলের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী স্রেফ গুম হয়ে গেছেন, যা হত্যার চেয়েও গুরুতর অপরাধ। এ সরকারের আমলে পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, শতাধিক কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে প্রমোশন, সরকারি ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ, ভারতকে পরিবহনসুবিধা দেওয়ার জন্য নিজ দেশের নদীর ওপর বেআইনিভাবে বাঁধ নির্মাণ এবং রামুতে বৌদ্ধ বসতি নিশ্চিহ্ন করার মতো অনেক ঘটনা ঘটেছে, যা প্রকার বা মাত্রার দিক দিয়ে বাংলাদেশে নজিরবিহীন। এসব ঘটনা প্রতিরোধ করতে ব্যর্থতার জন্য কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব ঘটানোর জন্য সরকারের নিন্দা না করা কোনো বিবেকবান মানুষের পক্ষে কীভাবে সম্ভব? আর সম্ভব হলে এ সরকারের ঘনিষ্ঠ লোকজনকে যেসব টিভি চ্যানেল দেওয়া হয়েছে, তাঁরা নিজেরা যেকোনো পরিস্থিতিতে সরকারের প্রশংসা করবেন—এমন লোকদের খুঁজে বের করতে পারছেন না কেন?
আমার সঙ্গে অনেকে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। কিন্তু আমার মনে হয়, বিগত সরকারের তুলনায় বরং এই সরকারের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা কিছু ক্ষেত্রে কম করা হয়। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারপন্থী একজন শিক্ষক প্রক্টরের গুরুদায়িত্ব পালনরত অবস্থায় ছাত্রফ্রন্টের একজন নারীকর্মীকে ঘুষি মারেন, এ ছবি বেশ কয়েকটি পত্রিকায় ছাপাও হয়। বিএনপির আমলে এই ঘটনা ঘটলে দেশে মানবাধিকার ও নারীবাদী সংগঠন এবং ‘সচেতন’ বিভিন্ন সমাজ জোরালো প্রতিবাদ করত এবং জাতির বিবেকসম ব্যক্তিরা এককভাবে, জোটবদ্ধ হয়ে কিংবা তাঁদের সংগঠনের নামে পত্রিকায় উপসম্পাদকীয় লিখতেন। এমন বহু প্রতিবাদ বিএনপির আমলে হয়েছে, হওয়াটা উচিতও ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের আমলের ঘটনা বলে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের বর্বরোচিত আচরণ বা অন্য বহু অঘটনের সমালোচনা তাঁদের অধিকাংশ নির্বিকারে এড়িয়ে যান কেন? আওয়ামী সরকারের আমলে জনপ্রিয় ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিদের অনেকে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেন কেন? প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হয়ে বর্তমান সরকারের সমালোচনাকারী হিসেবে যাঁদের নাম বলেছেন বা যাঁরা টক শোতে বর্তমান সরকারের সমালোচনা করে থাকেন, তাঁদের অধিকাংশ কি বিগত বিএনপি সরকারের সমালোচনা করা থেকে তখন কোনোভাবে পিছিয়ে ছিলেন?
সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা বাকস্বাধীনতা, জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার নীতির আলোকে দেখাই বাঞ্ছনীয়। প্রতিবেশী ভারত এ অঞ্চলে গণতন্ত্রচর্চায় তুলনামূলকভাবে এগিয়ে, সেখানে নাগরিক সমাজ তাদের সরকারের সমালোচনায় বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি তৎপর, জোরালো ও সার্বক্ষণিক। ভারতে মানবাধিকার, তথ্য স্বাধীনতা, অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠীর কল্যাণ ও সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন জনমুখী সিদ্ধান্তের ভিত্তিই হচ্ছে এই নাগরিক সমাজের কর্মতৎপরতা। নাগরিক সমাজের কণ্ঠ রুদ্ধ করে রাখলে দেশের কী পরিণতি হয়, তার বড় উদাহরণ পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সামপ্রতিক শ্রীলঙ্কা এবং আফ্রিকার বিভিন্ন অন্ধকারাচ্ছন্ন দেশ।
সবকিছুর পর এটিও সত্যি, সরকারের বিরুদ্ধে কিছু কিছু সমালোচনা পক্ষপাতদুষ্ট, একচোখা ও অসংযমী হয়ে ওঠে, এটি হওয়াটা অস্বাভাবিকও নয়। সবাই একইভাবে বা একই ভাষায় সমালোচনা করতে পারেন না, সবাই সৎ উদ্দেশ্যেও সমালোচনা করেন না। অসংগত সমালোচনার জবাব দেওয়ার জন্য সরকারি প্রচারমাধ্যম, অনেক মন্ত্রী, সরকারি দল এবং সরকারপন্থী লোকজন তো রয়েছেনই। সব জবাব প্রধানমন্ত্রীর মতো সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ একজনকে দিতে হবে কেন, আর দিলে তা অসংগত ভাষায় কেন?
গণমাধ্যমের সমালোচনার চেয়ে অস্বাভাবিক আচরণ হচ্ছে গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান থেকে বর্জন করা। কেন প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে অধিকাংশ বেসরকারি গণমাধ্যমকে না আসতে বলা হয়েছিল, তার কোনো স্বীকৃত কারণ আমরা এখনো জানতে পারিনি। তবে বিভিন্ন সূত্রের দেওয়া তথ্য অনুসারে দায়িত্বশীল পত্রিকাগুলো যে কারণ উদ্ঘাটন করেছে, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয় না বা পাঁচ-ছয় নম্বর নিউজ আইটেম হিসেবে প্রচারিত হয় বলেই নাকি সংবাদমাধ্যমগুলোকে এভাবে বর্জন করা হয়েছে!
এটি যদি সত্যি হয়, তাহলে তা স্বাধীন সাংবাদিকতা নীতিমালার পরিপন্থী। বিনয়ের সঙ্গে বলি, প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রের কেউ বেসরকারি গণমাধ্যমের নিউজ ট্রিটমেন্ট পলিসি ঠিক করে দিতে পারেন না। বেসরকারি গণমাধ্যম প্রধানত সংবাদের বাজার এবং এর গুরুত্ব বিবেচনা করে সংবাদ পরিবেশন করে থাকে। সরকারের গৎবাঁধা উন্নয়ন কার্যক্রম বা সরকারপ্রধানের রুটিন কার্যক্রম পাঠক/শ্রোতাদের কাছে কতটা অনাকর্ষণীয়, তা বিটিভির সংবাদ এবং সরকারি দলের মুখপত্র হিসেবে পরিচিত সংবাদপত্রগুলোর অজনপ্রিয়তা থেকে বোঝা যায়। তার পরও বাংলাদেশে এসব কার্যক্রম যেভাবে প্রচার করা হয়, উন্নত বিশ্বে তার সিকিভাগ প্রচারণা বেসরকারি এমনকি সরকারি প্রচারমাধ্যমে হয় কি না সন্দেহ। এই সরকারের আমলে এসব সংবাদ দেখতে বাধ্য করার চিন্তা থেকে বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোতে বিটিভির সংবাদ দিনে অন্তত একবার প্রচার করার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। সরকারের লোকজন গবেষণা করে দেখতে পারেন সে সংবাদ প্রচারের সময় টিভি দর্শকদের কত শতাংশ তা দেখে থাকেন!
আমরা মনে করি, কোন সংবাদ কীভাবে প্রচার করতে হবে তা সম্পূর্ণ বেসরকারি গণমাধ্যমের এখতিয়ারভুক্ত। এর ওপর খবরদারি অনাকাঙ্ক্ষিত। পর্যাপ্ত বা যথাযথ কাভারেজ দেওয়া হয়নি এটি ভেবে গণমাধ্যমের কোনো অংশকে সরাসরি সংবাদ সংগ্রহের অধিকার থেকে বঞ্চিত করাও অনাকাঙ্ক্ষিত।
গণমাধ্যমের প্রতি বৈরী বা রুষ্ট হওয়া কোনো অগণতান্ত্রিক শাসককে মানায়; জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী এবং দেশের একটি সুপ্রাচীন গণতান্ত্রিক দলের প্রধানকে নয়। দেশের প্রচলিত আইন বা সাংবাদিকতার নীতিমালা লঙ্ঘিত হলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার সরকারের আছে। কিন্তু সরকারের সমালোচনা হচ্ছে বা সরকারের সংবাদ ঠিকমতো প্রচার হচ্ছে না, এ কারণে গণমাধ্যমকে বর্জন করার কোনো অধিকার সরকারের নেই। সরকার সবার প্রতিষ্ঠান, এর ভালো-মন্দ আলোচনা করা বা এর কোনো কার্যক্রমের সংবাদ সংগ্রহ করা দেশের সংবিধান এবং আইন অনুসারে স্বীকৃত অধিকার। এই অধিকারকে উপেক্ষা করলে বা এই অধিকারের প্রয়োগে রুষ্ট হলে সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে এবং গণতন্ত্র বিপন্ন হবে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
১/১১-পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের সে সময়ে সাংবাদিকেরা রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর এবং অন্য রাজনৈতিক নেতাদের হয়রানির বিশদ বিবরণ তুলে ধরা ছাড়াও সে সময় বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো বিভিন্ন টক শোর মাধ্যমে দুই নেত্রীর পক্ষে জনমত পুনরুজ্জীবনের গুরুদায়িত্ব পালন করেন। বিগত সংসদ নির্বাচন চলাকালীন কিছু চ্যানেল দৃশ্যমানভাবে আওয়ামী লীগের পক্ষাবলম্বনও করে।
নিয়তির পরিহাস হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই এখন বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্রকে অঘোষিতভাবে বর্জন করেছেন। গত এক সপ্তাহে তাঁর কয়েকটি সরকারি অনুষ্ঠানে সংবাদ সংগ্রহের জন্য কেবল বিটিভি, বাসসসহ চারটি প্রতিষ্ঠানের সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়, বাকিদের আসতে বারণ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী নিজে বেসরকারি টিভির টক শোতে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যরাতের সিঁধেল চোর উপমা দিয়ে সমালোচনা করেন। প্রধানমন্ত্রীর এই সমালোচনার ভাষা অযৌক্তিক এবং অগ্রহণযোগ্য বলে অনেকের কাছে বিবেচিত হয়েছে। কিন্তু এর চেয়েও অগ্রহণযোগ্য হচ্ছে তাঁর অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বর্জন করা। বিরোধী দলের নেতা থাকাকালীন তিনি কয়েকটি চ্যানেলকে কিছুদিনের জন্য বর্জন করেছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর বর্জন আরও গুরুতর।
বোঝা যায় সার্বিকভাবে প্রধানমন্ত্রী গণমাধ্যমের ওপর রুষ্ট হয়ে আছেন। বিশেষ করে টক শোর প্রতি তাঁর ক্ষোভ অপরিসীম। বিরোধী দলের সংসদ বর্জন এবং বুদ্ধিদীপ্ত সমালোচনায় সামর্থ্যের ঘাটতির কারণে টক শোর আলোচকদের শাণিত সমালোচনা সরকারের কাছে প্রধান মাথাব্যথা হয়ে উঠেছে। সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এসব সমালোচনা খুব অগ্রহণযোগ্য মনে হতে পারে। অতীতের অন্যান্য সরকারপ্রধানদের মতো তিনিও নিশ্চয়ই স্তাবক এমনকি চাটুকার পরিবেষ্টিত থাকেন। এ রকম অবস্থায় থেকে মধ্যরাতের তীক্ষ তীব্র প্রতিবাদী কণ্ঠ তাঁর কাছে গলাকাটা ছুরির মতো মনে হতে পারে! এমন মনে হওয়া অস্বাভাবিক কিছু হয়তো নয়। কিন্তু অস্বাভাবিক হচ্ছে এতে রুষ্ট হয়ে প্রকাশ্যে ও ঢালাওভাবে টক শোর আলোচকদের সিঁধেল চোরের সঙ্গে তুলনা করা।
আমরা প্রধানমন্ত্রীকে সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করতে চাই, গত বিএনপি শাসনামলে ‘ক্রসফায়ার’, বিএনপি-জামায়াত ক্যাডারদের সন্ত্রাস, সরকারের দুর্নীতি ও দলীয়করণের যে চাঁছাছোলা সমালোচনা টক শো, বিভিন্ন সেমিনার এবং পত্রিকার সম্পাদকীয়গুলোতে করা হয়েছে, তা কি তাঁর কাছে অযৌক্তিক মনে হতো? বিএনপির আমলের সমালোচনা যদি অযৌক্তিক না হয়ে থাকে, তাহলে বর্তমান আমলের গুম/হত্যা, ছাত্রলীগের সন্ত্রাস, বিভিন্ন দুর্নীতি এবং চরম দলীয়করণের সমালোচনা অযৌক্তিক কেন হবে? আমি নিজে বিশ্বাস করি বর্তমান সরকার আমলে ব্যর্থতা ও অপরাধের মাত্রা কিছু ক্ষেত্রে আগের সরকারগুলোর তুলনায় বরং বেশি। এটি সত্যি, এই সরকারের আমলে বিএনপি আমলের মতো ২১ আগস্ট ধরনের পৈশাচিক হামলা হয়নি, বিরোধী দলের কোনো সাংসদের জীবননাশ হয়নি, জঙ্গিবাদী তাণ্ডব দেখা যায়নি। কিন্তু এটিও তো সত্যি এ সরকারের আমলে ইলিয়াস আলীসহ বিরোধী দলের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী স্রেফ গুম হয়ে গেছেন, যা হত্যার চেয়েও গুরুতর অপরাধ। এ সরকারের আমলে পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, শতাধিক কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে প্রমোশন, সরকারি ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ, ভারতকে পরিবহনসুবিধা দেওয়ার জন্য নিজ দেশের নদীর ওপর বেআইনিভাবে বাঁধ নির্মাণ এবং রামুতে বৌদ্ধ বসতি নিশ্চিহ্ন করার মতো অনেক ঘটনা ঘটেছে, যা প্রকার বা মাত্রার দিক দিয়ে বাংলাদেশে নজিরবিহীন। এসব ঘটনা প্রতিরোধ করতে ব্যর্থতার জন্য কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব ঘটানোর জন্য সরকারের নিন্দা না করা কোনো বিবেকবান মানুষের পক্ষে কীভাবে সম্ভব? আর সম্ভব হলে এ সরকারের ঘনিষ্ঠ লোকজনকে যেসব টিভি চ্যানেল দেওয়া হয়েছে, তাঁরা নিজেরা যেকোনো পরিস্থিতিতে সরকারের প্রশংসা করবেন—এমন লোকদের খুঁজে বের করতে পারছেন না কেন?
আমার সঙ্গে অনেকে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। কিন্তু আমার মনে হয়, বিগত সরকারের তুলনায় বরং এই সরকারের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা কিছু ক্ষেত্রে কম করা হয়। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারপন্থী একজন শিক্ষক প্রক্টরের গুরুদায়িত্ব পালনরত অবস্থায় ছাত্রফ্রন্টের একজন নারীকর্মীকে ঘুষি মারেন, এ ছবি বেশ কয়েকটি পত্রিকায় ছাপাও হয়। বিএনপির আমলে এই ঘটনা ঘটলে দেশে মানবাধিকার ও নারীবাদী সংগঠন এবং ‘সচেতন’ বিভিন্ন সমাজ জোরালো প্রতিবাদ করত এবং জাতির বিবেকসম ব্যক্তিরা এককভাবে, জোটবদ্ধ হয়ে কিংবা তাঁদের সংগঠনের নামে পত্রিকায় উপসম্পাদকীয় লিখতেন। এমন বহু প্রতিবাদ বিএনপির আমলে হয়েছে, হওয়াটা উচিতও ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের আমলের ঘটনা বলে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের বর্বরোচিত আচরণ বা অন্য বহু অঘটনের সমালোচনা তাঁদের অধিকাংশ নির্বিকারে এড়িয়ে যান কেন? আওয়ামী সরকারের আমলে জনপ্রিয় ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিদের অনেকে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেন কেন? প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হয়ে বর্তমান সরকারের সমালোচনাকারী হিসেবে যাঁদের নাম বলেছেন বা যাঁরা টক শোতে বর্তমান সরকারের সমালোচনা করে থাকেন, তাঁদের অধিকাংশ কি বিগত বিএনপি সরকারের সমালোচনা করা থেকে তখন কোনোভাবে পিছিয়ে ছিলেন?
সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা বাকস্বাধীনতা, জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার নীতির আলোকে দেখাই বাঞ্ছনীয়। প্রতিবেশী ভারত এ অঞ্চলে গণতন্ত্রচর্চায় তুলনামূলকভাবে এগিয়ে, সেখানে নাগরিক সমাজ তাদের সরকারের সমালোচনায় বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি তৎপর, জোরালো ও সার্বক্ষণিক। ভারতে মানবাধিকার, তথ্য স্বাধীনতা, অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠীর কল্যাণ ও সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন জনমুখী সিদ্ধান্তের ভিত্তিই হচ্ছে এই নাগরিক সমাজের কর্মতৎপরতা। নাগরিক সমাজের কণ্ঠ রুদ্ধ করে রাখলে দেশের কী পরিণতি হয়, তার বড় উদাহরণ পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সামপ্রতিক শ্রীলঙ্কা এবং আফ্রিকার বিভিন্ন অন্ধকারাচ্ছন্ন দেশ।
সবকিছুর পর এটিও সত্যি, সরকারের বিরুদ্ধে কিছু কিছু সমালোচনা পক্ষপাতদুষ্ট, একচোখা ও অসংযমী হয়ে ওঠে, এটি হওয়াটা অস্বাভাবিকও নয়। সবাই একইভাবে বা একই ভাষায় সমালোচনা করতে পারেন না, সবাই সৎ উদ্দেশ্যেও সমালোচনা করেন না। অসংগত সমালোচনার জবাব দেওয়ার জন্য সরকারি প্রচারমাধ্যম, অনেক মন্ত্রী, সরকারি দল এবং সরকারপন্থী লোকজন তো রয়েছেনই। সব জবাব প্রধানমন্ত্রীর মতো সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ একজনকে দিতে হবে কেন, আর দিলে তা অসংগত ভাষায় কেন?
গণমাধ্যমের সমালোচনার চেয়ে অস্বাভাবিক আচরণ হচ্ছে গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান থেকে বর্জন করা। কেন প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে অধিকাংশ বেসরকারি গণমাধ্যমকে না আসতে বলা হয়েছিল, তার কোনো স্বীকৃত কারণ আমরা এখনো জানতে পারিনি। তবে বিভিন্ন সূত্রের দেওয়া তথ্য অনুসারে দায়িত্বশীল পত্রিকাগুলো যে কারণ উদ্ঘাটন করেছে, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয় না বা পাঁচ-ছয় নম্বর নিউজ আইটেম হিসেবে প্রচারিত হয় বলেই নাকি সংবাদমাধ্যমগুলোকে এভাবে বর্জন করা হয়েছে!
এটি যদি সত্যি হয়, তাহলে তা স্বাধীন সাংবাদিকতা নীতিমালার পরিপন্থী। বিনয়ের সঙ্গে বলি, প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রের কেউ বেসরকারি গণমাধ্যমের নিউজ ট্রিটমেন্ট পলিসি ঠিক করে দিতে পারেন না। বেসরকারি গণমাধ্যম প্রধানত সংবাদের বাজার এবং এর গুরুত্ব বিবেচনা করে সংবাদ পরিবেশন করে থাকে। সরকারের গৎবাঁধা উন্নয়ন কার্যক্রম বা সরকারপ্রধানের রুটিন কার্যক্রম পাঠক/শ্রোতাদের কাছে কতটা অনাকর্ষণীয়, তা বিটিভির সংবাদ এবং সরকারি দলের মুখপত্র হিসেবে পরিচিত সংবাদপত্রগুলোর অজনপ্রিয়তা থেকে বোঝা যায়। তার পরও বাংলাদেশে এসব কার্যক্রম যেভাবে প্রচার করা হয়, উন্নত বিশ্বে তার সিকিভাগ প্রচারণা বেসরকারি এমনকি সরকারি প্রচারমাধ্যমে হয় কি না সন্দেহ। এই সরকারের আমলে এসব সংবাদ দেখতে বাধ্য করার চিন্তা থেকে বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোতে বিটিভির সংবাদ দিনে অন্তত একবার প্রচার করার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। সরকারের লোকজন গবেষণা করে দেখতে পারেন সে সংবাদ প্রচারের সময় টিভি দর্শকদের কত শতাংশ তা দেখে থাকেন!
আমরা মনে করি, কোন সংবাদ কীভাবে প্রচার করতে হবে তা সম্পূর্ণ বেসরকারি গণমাধ্যমের এখতিয়ারভুক্ত। এর ওপর খবরদারি অনাকাঙ্ক্ষিত। পর্যাপ্ত বা যথাযথ কাভারেজ দেওয়া হয়নি এটি ভেবে গণমাধ্যমের কোনো অংশকে সরাসরি সংবাদ সংগ্রহের অধিকার থেকে বঞ্চিত করাও অনাকাঙ্ক্ষিত।
গণমাধ্যমের প্রতি বৈরী বা রুষ্ট হওয়া কোনো অগণতান্ত্রিক শাসককে মানায়; জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী এবং দেশের একটি সুপ্রাচীন গণতান্ত্রিক দলের প্রধানকে নয়। দেশের প্রচলিত আইন বা সাংবাদিকতার নীতিমালা লঙ্ঘিত হলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার সরকারের আছে। কিন্তু সরকারের সমালোচনা হচ্ছে বা সরকারের সংবাদ ঠিকমতো প্রচার হচ্ছে না, এ কারণে গণমাধ্যমকে বর্জন করার কোনো অধিকার সরকারের নেই। সরকার সবার প্রতিষ্ঠান, এর ভালো-মন্দ আলোচনা করা বা এর কোনো কার্যক্রমের সংবাদ সংগ্রহ করা দেশের সংবিধান এবং আইন অনুসারে স্বীকৃত অধিকার। এই অধিকারকে উপেক্ষা করলে বা এই অধিকারের প্রয়োগে রুষ্ট হলে সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে এবং গণতন্ত্র বিপন্ন হবে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন