শনিবার, জুলাই ২১, ২০১২

লোক দেখানো মনিটরিং বলে দাবি করেছেনঃ সাধারণ ভোক্তারা

মুহাম্মাদ ইসরাফিল মোল্লাঃ
পর্যাপ্ত মজুদ থাকায় বাড়বে না নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এমনটা বলছেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু বাজার ঘুরে মিলছে ভিন্ন চিত্র। এদিকে বাজার নিয়ন্ত্রণে ১৫জুলাই থেকে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গঠিত পাঁচটি টিম নগরীর ১৭টি বাজার মনিটরিং শুরু করবে। তবে সাধারণ ভোক্তা এবং ব্যবসায়ী উভয়ই এটাকে লোক দেখানো মনিটরিংবলে দাবি করেছেন। সাধারণ ভোক্তারা বলছেন,
ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ে গঠিত টিমের মাধ্যমেসাময়িক এই মনিটরিংসাধারণ ভোক্তাদের জন্য কোন সুফল বয়ে আনবে কি না তা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। জানা গেছে, রমজানকে সামনে রেখে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে ভোগ্যপণ্যের দাম। একইসাথে ব্যর্থ হতে যাচ্ছে পণ্যমূল্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের নানা উদ্যোগ। এদিকে আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা সর্বোচ্চ ১ শতাংশ এবং খুচরা বিক্রেতারা ১০ শতাংশ মুনাফা করতে পারবেন বলে নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। তবে বাজার ঘুরে দেখা গেছে, পাইকারি এবং খুচরা ব্যবসায়ীরা মানছেন না সরকারের এই নির্দেশনা। এমতাবস্থায় বাজার নিয়ন্ত্রণে মনিটরিং কার্যক্রম শুরু করছে সরকার।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গত ৯ জুলাই জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তের আলোকে ১৫ জুলাইথেকে চট্টগ্রামে বাজার মনিটরিং শুরু হবে। সকাল দশটায় মনিটরিং টিমের সদস্যরা সার্কিট হাউসে মিলিত হবেন। এরপর পাঁচটি টিমে ভাগ হয়ে মনিটরিং করবেন নগরীর ১৭টি বাজার। একইসাথে প্রতিটি উপজেলায়ও স্ব-স্ব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি মনিটরিং টিম কাজ করবে। প্রতিটি মনিটরিং টিমে ৮ থেকে

১০ জন করে সদস্য থাকবেন। একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে সিটি করপোরেশন, বিএসটিআই,চেম্বার, ক্যাব, র‌্যাব, পুলিশ ও বাজার কমিটির প্রতিনিধির সমন্বয়ে এসব টিম গঠন করা হবে। টিমের সদস্যরা বিভিন্ন বাজারে খুচরা ব্যবসায়ীদের পণ্য কেনার রশিদ, বাজারে মূল্য তালিকা টাঙ্গানো রয়েছে কী না তাও প্রত্যক্ষ করবেন।

১৪জুলাই বাজার পরিস্থিতি : নগরীর বিভিন্ন বাজার পরিদর্শনে দেখা যায়, এখনো পর্যন্ত টাঙ্গানো হয় নি মূল্য তালিকা। একইসাথে ভোক্তাদের কাছ থেকে ইচ্ছেমত আদায় করা হচ্ছে পণ্যমূল্য। যদিও গত ৯ জুলাই অনুষ্ঠিত সভায় উপস্থিত ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ স্ব স্ব সংগঠনের সদস্যদের মূল্য তালিকা টাঙ্গানোর বিষয়টি অবহিত করবেন বলা হয়েছিল। এসময় ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত দাম আদায় করা হবে না বলে আশ্বস্থ করেছিলেন। একইসাথে চট্টগ্রাম বন্দরে খালাসকৃত পণ্যের আলোকে এবং ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। ফলে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে পণ্যমূল্য বাড়ার সুযোগ নেই।

১৪জুলাই বাজার পরিদর্শনে দেখা গেছে, দুই সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতিটি পণ্যের দামই বেড়েছে। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৫৬ টাকায়। যা দুই সপ্তাহ আগে ছিল ৫০ থেকে ৫২ টাকা। তবে শুক্রবার পাইকারি বাজারে প্রতিমণ চিনি ২ হাজার ২০ টাকায় বিক্রি হলেও গতকাল বিক্রি হয়েছে ১৯শ ৫০ টাকায়। শুক্রবার প্রতি কেজি ইন্ডিয়ান পিঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ২৪ টাকায়। গতকাল ২ টাকা কমে বিক্রি হয়েছে ২২ টাকায়। পাইকারি বাজারে পিঁয়াজের মূল্য ছিল ১৮ টাকা। তবে এক সপ্তাহ আগে ৮০ টাকায় বিক্রি হওয়া রসুন এখন বিক্রি হচ্ছে ৯৬ টাকায়। দুই সপ্তাহ আগে ৪০ টাকায় বিক্রি হওয়া আদার মূল্য ছিল ৫২ থেকে ৫৬ টাকা। পাইকারি বাজারে আদার মূল্য ছিল ৪২ থেকে ৪৩ টাকা। দুই সপ্তাহ আগে ৮০ টাকায় বিক্রি হওয়া উন্নত মানের ছোলা গতকাল বিক্রি হচ্ছিল ৯০ টাকায়, মাঝারি এবং নিম্নমানের ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৮৬ থেকে ৭৪ টাকায়। মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ১১৬ টাকায়, দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ১০ টাকা বেড়ে মটর ডাল বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকায়, খেসারি বিক্রি হচ্ছে ৫৬ টাকায়। পাইকারি বাজারে রায়পুরের মরিচ বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ টাকায়, ইন্ডিয়ান মরিচ ১২৫ থেকে ১৩০ টাকায়, কাচা দেশী হলুদ ৭০ টাকা, ইন্ডিয়ান হলুদ ৭৫ টাকা। ধনিয়া পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা এবং খুচরা বাজারে ৬০ টাকা। বোতলজাত ৫ লিটার সয়াবিন তেল ৬শ ৬৫ টাকা, ২ লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ২শ ৬২ টাকা, ১ লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১শ ৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খোলা সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে (লিটার প্রতি) ১শ ২৪ টাকায়। এদিকে ডিমের দাম প্রতি হালিতে ২ থেকে ৩ টা কমে বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৩৬ টাকায়।

অভিযোগ রয়েছে, বিপুল পরিমাণ মজুদ থাকা সত্ত্বেও ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন পন্থায় দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)র হিসাবে গত জুনের শেষ সপ্তাহে এর আগের সপ্তাহের তুলনায় নতুন করে দাম বেড়েছে ভোজ্যতেল সয়াবিন, পামঅয়েল,ডালের। এর মধ্যে ডালের দাম বেশ কিছুদিন ধরে বাড়তির দিকে। এছাড়া এক মাসে দাম বেড়েছে এমন পণ্যের তালিকায় রয়েছে লবণ,ডিম,ছোলা ও সব ধরনের সবজি। সম্প্রতি সরকারের এক নির্দেশনায় বলা হয়, আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা সর্বোচ্চ ১ শতাংশ এবং খুচরা বিক্রেতারা ১০ শতাংশ মুনাফা করতে পারবেন। এছাড়া গত ২৬ জুন বাণিজ্য মন্ত্রীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ব্যবসায়ীরা সরকারকে আশ্বস্থ করেছিলেন ডাল, ছোলা, পিঁয়াজ, রসুনসহ কয়েকটি পণ্যে ১০ শতাংশের বেশি মুনাফা করবেন না।

সংশ্লিষ্টরা যা বলেন : অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) এহছানে এলাহী বলেন- মনিটরিং টিম ভ্রাম্যমাণ আদলত নয়, তবে আদালতের ন্যায় কাজ করবে।

গত সোমবার বাজার মনিটরিং কমিটির সভায় চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সিনিয়র সহ-সভাপতি ও খাতুনগঞ্জ ট্রেড ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেছিলেন, এবারের রমজানে পণ্যের কৃত্রিম সংকট হবে না। ব্যবসায়ীরা আন্তরিক হওয়ায় গত বছরের চেয়ে এবার দামও অনেক কম। ব্যবসায়ীদের কাছে পণ্যের মজুদ আছে বলেই দাম কম।

কনজ্যুমার এসোসিয়েশন (ক্যাব) এর চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি নাজের হোসাইন বলেন,বর্তমান বাজার মূল্য নাগালের বাইরে। মনিটরিং টিমে ব্যবসায়ী প্রতিনিধির আধিক্যতা থাকায় সাফল্য কিছুটা বিঘ্নিত হতে পারে। কারণ যে মার্কেটে মনিটরিং টিম যাবেন ওই মার্কেটের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা যদি আগে থেকে অন্য ব্যবসায়ীদের অবহিত করে দেন তাহলে মনিটরিং টিম পৌঁছার আগেই অসাধু ব্যবসায়ীরা সতর্ক হয়ে যাবেন।

খাতুনগঞ্জ হামিদ উল্লাহ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. নুরুল আলম জানান, এখনো পণ্যমূল্যের তালিকা টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয় নি। মনিটরিংয়ের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ সমব নয়। এটা লোক দেখানো। দেশে যদি উৎপাদন বাড়ানো না যায় দ্রব্যমূল্য বাড়বেই।

কর্ণফুলী মার্কেট দোকান মালিক সমিতির সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন জানান, এখনো পর্যন্ত আমাদের মার্কেটে দ্রব্যমূল্যের তালিকা টাঙ্গানো হয় নি। (১৫জুলাই শনিবার) সন্ধ্যায় এই বিষয়ে ব্যবসায়ীদের সাথে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

শাহরিয়ার পারভেজ শাকিল নামে জনৈক ব্যাংক কর্মকর্তা জানান, রমজান আসলে একমাস মনিটরিং লোক দেখানো। কারণ মনিটরিং হওয়া সত্ত্বেও প্রতি বছর রমজানেই বেড়ে যায় পণ্যমূল্য।
প্রথমদিনের বাজার মনিটরিং।
অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ছাড়াই শেষ হলো প্রথমদিনের বাজার মনিটরিং। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গঠিত ৫টি টিম গতকাল নগরীর বিভিন্ন বাজার মনিটরিং করে। এসময় বিভিন্ন বাজারে ব্যবসায়ীদের নানা অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেলেও তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে শুধু সতর্ক করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, রমজানে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সহনীয় রাখা এবং বাজারের বিভিন্ন অনিয়ম রোধ করার জন্য বাজার মনিটরিং কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ এ মনিটরিংয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। গতকাল নগরীর বিবির হাট, কর্ণফুলী মার্কেট,কাজীর দেউরী বাজার, স্টিল মিল বাজার, রেয়াজুদ্দিন বাজারসহ বিভিন্ন বাজার পরিদর্শন করেন মনিটরিং দল। এসব বাজারে মূল্য তালিকা টাঙানো, বাজারের সামনে অভিযোগ বাক্স রাখা, পাইকারি বিক্রেতাদের দেওয়া রসিদ, খুচরা মূল্যে পার্থক্য ইত্যাদি বিষয় খতিয়ে দেখেন মনিটরিং টিম। এসময় বিভিন্ন বাজারে নানা অনিয়ম পাওয়া গেলেও প্রথম দিন হিসেবে ব্যবসায়ীদের শুধু সতর্ক করা হয়েছে। পাশাপাশি খুচরা বিক্রেতাদের মাত্রাতিরিক্ত লাভ, ওজনে কম দেওয়া, ভেজাল ও ফরমালিন বা কার্বাইডযুক্ত খাদ্যপণ্য বিক্রি না করতে সতর্ক করা হয়।

মনিটরিং টিমের সদস্য এবং উন্নয়ন কর্মী পারভীন আক্তার জানান, পরিদর্শনকালে দেখা যায় চকবাজার এবং রিয়াজুদ্দিন বাজারে মূল্য তালিকা টাঙ্গানো হয় নি। চিনিসহ কয়েকটি পণ্যের মূল্য একেক বাজারের একেক রকম। চকবাজারে এক বিক্রেতার নিকট চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন প্রদত্ত একটিমাত্র খাসী জবাইয়ের রশিদ থাকলেও তিনি বিক্রি করছিলেন তিনটি খাসীর মাংস। অবশিষ্ট দুটি খাসীর বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি ওই মাংস বিক্রেতা। অবশিষ্ট

খাসী দুটি মৃতও হতে পারে। এসময় ম্যাজিস্ট্রেট ওই মাংস বিক্রেতার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে শুধু সতর্ক করে দেন। পারভীন আক্তার রমজান ছাড়াও সারা বছর মনিটরিং কার্যক্রম অব্যাহত রাখার দাবি জানান।

জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল্লাহ আল আরিফ জানান, প্রথম দিন বিক্রেতারা তাদের পণ্যের ক্রয় ও বিক্রয়মূল্য তালিকা সঙ্গে রেখেছেন কিনা তা পরীক্ষা করেছি। এছাড়া তারা পণ্য বিক্রয়ের সময় ক্রেতাদের তা দেখাচ্ছেন কিনা তাও পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। দেখা গেছে, অধিকাংশ দোকানেই পণ্যমূল্য তালিকা নেই। তবে ভবিষ্যতে তালিকা না থাকলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তাদের সতর্ক করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, গত ৯ জুলাই জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত জেলা টাস্কফোর্স কমিটি, বাজার মনিটরিং কমিটি ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ীদের সাথে মতবিনিময় সভায় সিদ্ধান্ত হয় রমজান উপলক্ষে সপ্তাহে দুদিন নগরীর ১৭ টি বাজার মনিটরিং করা হবে। গতকাল মনিটরিং টিমে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই), চট্টগাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডস্ট্রি, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, চট্টগ্রাম উইম্যান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব), র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র‌্যাব), চট্টগ্রাম নগর পুলিশ (সিএমপি), বাজার কমিটির প্রতিনিধিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।


1 টি মন্তব্য: